Tuesday 5 March 2024

বইয়ের দুনিয়া

 



বইয়ের দুনিয়া


সেটা বোধহয় ২০০৫ সালের কথা
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ মানেই বইমেলার শুরু আর প্রায় পনেরো বছর ধরে বা বেশীও হতে পারে এই বইমেলার সময় বিশেষ সংখ্যা বার করে দেশ পত্রিকা প্রথমের দিকে বইমেলা সংখ্যা নামে না থাকলেও পরবর্তীতে এই নাম চালু হয়ে যায় এই পত্রিকার পাঠকমাত্রই জানেন যে বই সম্বন্ধীয় লেখা আর বইয়ের বিজ্ঞাপণের জন্য এই সংখ্যাটি বই পড়ুয়াদের বিশেষ পছন্দ

তা পাড়ার মুখে গেছি, আমাদের ছোটকাদার কাগজের দোকানে, দেখি এক ছোট বই, নাম বইয়ের দেশ আমি ভাবলাম বোধহয় বই সংখ্যা ছোট হয়ে বেরিয়েছে কিনে বাড়ি নিয়ে গেলাম বেশ অন্য রকম বই বই নিয়ে প্রায় দু তিন পাতা আলোচনা, বিশাল সাক্ষাৎকার, শেষের দিকে সদ্য প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য বইয়ের তালিকা, প্রকাশক ও মূল্য সহ এর কিছুদিন পরেই দেশের নিয়মিত বই সংখ্যা বের হয় আমরা বই নিয়ে এক নতুন পত্রিকা উপহার পেলাম চেষ্টা করেছি প্রত্যেকটা পত্রিকা রাখার একটা অনলাইন সংখ্যা বাদ দিয়ে সবকটি সংখ্যাই সম্ভবত আছে

এতগুলো কথা বলতে হল একটা ঘটনায় আমি সেদিন জানুয়ারির প্রথমে সন্দীপ দাশগুপ্তের পুজোসংখ্যার অলঙ্করণ বইটি কিনে পড়েছি পড়ে এক রাশ ভালোলাগার কথাই জানিয়েছিলাম ফেসবুকে পরদিন সকালে আমার ফেসবুক বন্ধু পার্থ মুখোপাধ্যায় মেসেঞ্জারে জানালেন, লেখাটি একটি বইয়ের পত্রিকার জন্য চাই অনুমতি চান আমি সানন্দে অনুমতি দিলাম বললেন বইমেলা সংখ্যায় লেখাটি বেরোবে

একটু পরেই তিনি পত্রিকার এক পিডিএফ পাঠালেন হোয়াটসঅ্যাপে পত্রিকার নাম বইয়ের দুনিয়া নভেম্বর মাসের সংখ্যা মূল্য দশ টাকা ট্যাবলয়েড গোত্রের আটপাতার পত্রিকা এরপর বইমেলা শুরু হয়েছে, নানান কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি শেষের দিন পার্থবাবুর ফোন, বই মেলায় আসুন পত্রিকা নিয়ে যান তা যাওয়া হয়ে ওঠে নি, পরে আমার শ্যামবাজারের লক্ষণদার দোকানে পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন পত্রিকা কেমন লাগলো তাও জানাতে বলেনআলস্যতাবশত এবং কাজের চাপে তা হয়ে ওঠেনি তাই ছোট করে একটু জানিয়ে দিই

এই পত্রিকার নাম আগে জানতাম না সে আমার অজ্ঞানতা বইমেলা সংখ্যাটি জানুয়ারি মাসের পৃষ্ঠা সংখ্যা কুড়ি পাতার ডান দিকের কলমে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পুরস্কার প্রাপ্তির খবর পাশেই টিম বুচারের ব্লাড রিভার বইটি নিয়ে সুবীর কুমার ঘোষের আলোচনা, নীচেই এডওয়ার্ড লিয়ার কে নিয়ে শেখর বসুর লেখা

ফারসি কবিতা নিয়ে বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তীর লেখা রাধাপ্রসাদ গুপ্ত কে নিয়ে বা তার কলকাতার শব্দ নিয়ে সরজিৎ সেনগুপ্তের প্রবন্ধ পুরনো কথা মনে করিয়ে দেয় অন্বয় গুপ্তের - যে শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে আলোচনা হয় না বলে দু পাতা জোড়া প্রবন্ধটি পত্রিকার সম্পদ নতুন বই শীর্ষনামে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের গৌতম বুদ্ধের পথ ধরে, গৌতম মিত্রের প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত নিয়ে নিজেরাই আলোচনা করেছেন মনে পড়ে শীর্ষক আলোচনায় বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে বলেছেন, ছবিও তাঁর আঁকা 

আরো অনেক আলোচনার মধ্যে আমার লেখাটি স্থান পেয়ে নিয়েছে পত্রিকার পাতায় লেখাটা দেখার পর বুঝেছি লেখাটি একটু বড়ই হয়ে গেছে যারা লেখাটি ধৈর্য ধরে পড়েছেন এবং সম্পাদকীয় দপ্তর যারা লেখাটি মনোনয়ন করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই।


অনেক বছর পরে কাগজের পাতায় নিজের নাম দেখতে পেয়ে ভালোই লেগেছে কিন্তু বাবার নাম দেখে আমার পুত্র সন্তানের আনন্দই আমার বড় প্রাপ্তি


বইয়ের দুনিয়া
জানুয়ারি ২০২৪
মূল্যঃ ২০.০০ টাকা

Wednesday 3 January 2024

পুজোসংখ্যার অলংকরণ
পুজোসংখ্যার অলংকরণ
সন্দীপ দাশগুপ্ত
প্রতিক্ষণ
মূল্য ২০০.০০

খু মন খারাপ ভালো করার এক ওষুধ আমি আবিষ্কার করেছিলাম শিলিগুড়ি থাকাকালীন। তখন খবরের কাগজের কাজে একা থাকি অফিস মেসে। সেই সময় পরপর কয়েকটি ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যায় আমার কলকাতার জীবনে। কিন্তু সেখানে আমি অনুপস্থিত, ফলে কিছু করার নেই, ফেরার উপায় নেই। সেই সময় আমার কাজ শুরু হত, অন্যান্য কাগজের মতই বিকেলের দিকে, ফলে সারা সকাল-দুপুর এক অসহ্য সময় কাটাতে হয়েছে।
আগেও গেছি, তা একদিন বেরিয়ে আশুতোষ মুখার্জি রোডে আনন্দ পাবলিশার্সের দোকানে চলে গেলাম। ঘন্টা তিনেক কাটিয়ে দেখলাম, ওই সময়টুকু আমার কোন মন খারাপের কথা মনে হয়নি। এর পর কয়েকদিন একইভাবে আনন্দের দোকানে চলে গেছি, পরিচয় ভালোই হয়ে গিয়েছিল। কোনদিন ভদ্রলোক (লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি, নাম ভুলে গেছি) কোনদিন তার স্ত্রী দোকানে থাকতেন।  দোকান বন্ধ থাকলেও ফোন করে গেলে নিজে এসে খুলে দিতেন। তার মানে এই নয় যে আমি প্রতিদিন বই কিনতাম, আসলে আমার বইয়ের সান্নিধ্য ভালো লাগত, আমি ভুলে থাকতে পারতাম আমার দুঃখের কথা। যে দিন বাধ্য হয়ে শিলিগুড়ি ছেড়ে চলে আসি, সেইদিন অনেকগুলি বই কিনে, কিছু বাকি টাকা ফেরত দিয়ে কলকাতা ফিরেছিলাম।

এই সেদিন হঠাৎ এক মৃত্যুর খবরে আমার মন তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমে কথাটা রেজিস্টারই করেনি। যখন করল তখন একই সঙ্গে মন ও শরীর দুটোই বেশ বিদ্রোহ করে উঠল। তারপর ডাক্তার-বদ্যি, ওষুধপথ্য। দুদিন শয্যাশায়ী। তারপর সেই পুরনো ওষুধ ব্যবহার করলাম। নেমে পড়লাম কলেজ স্ট্রিটে। প্রতিক্ষণ  এর দোকানে আসা হয়নি কোনদিন। গিয়ে ঢুকে পড়লাম। সুন্দর সাজানো গোছানো বইয়ের দোকান, কয়েকজন ক্রেতাও আছেন। নানান প্রকাশনের একটু হটকে বইয়ের খনি দোকানটা। আছে বাংলাদেশের বই। প্রচুর আর্টপ্রিন্ট, যোগেন চৌধুরীর নোট বুকের ফ্যাক্সিমিলি। ছোটখাট হ্যান্ড ক্রাফটেড নোটবই ও অন্যান্য। এক কাপ সুন্দর চা এর মধ্যেই পরিবেশন হয়ে গেছে।
এর মধ্যেই আমি জেনেছি, সন্দীপ দাশগুপ্তের বই বেরিয়েছে। বইয়ের বিষয়বস্তু অলংকরণ। এর মধ্যেই রোচিষ্ণু তার পোস্টে মজা করিয়া পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও বলে যে ভাবে হাক পেড়ে পোস্ট দিয়েছে তাতে তো ভেবেছি যে বই আর পাওয়া হল না। তা গিয়ে দেখি বই আছে, আগেই একটা বগলদাবা করে অন্যান্য বই দেখে বাড়ি ফিরলাম।


দোকানে গিয়ে তো বইটা এক ঝলক দেখেছি, কিন্তু বাড়ি এসে জলখাবার আর চা খেতে খেতে বইটা অর্ধেক শেষ। তারপর রাত্রির খাবারের আগেই পুরো শেষ। তাঁর বাবা সুবোধ দাশগুপ্ত কে নিয়ে নানান পোস্ট পড়েছি, শিশির মঞ্চে বন্ধু শান্তনু সাহার পরিচালনায় দেখা হয়ে গেছে কলমিলতা ও কাঁচডানার গল্প। বাবাকে নিয়ে হাওড়া ও একাডেমিতে দুটো প্রদর্শনীও করেছেন তিনি। দুটোই দেখেছি গিয়ে।
সন্দীপ বাবুর কিছু লেখা আগে ফেসবুকে পড়েছি। তার ভাষা সচল, টিবি স্যানিটোরিয়াম নিয়ে এক লেখা পড়ে আমার রেমার্কের একটা লেখার কথা মনে হয়েছিল। যাই হোক, বইয়ের কথায় আসি, লেখা শুরু হয়েছে এইভাবে, পুজোসংখ্যার অনুরাগী হওয়ার জন্য খুব যে দেবদ্বিজে ভক্তি থাকার দরকার পড়ে এমন তো নয়। বাঙালি হওয়ার দরকার পড়ে। ……”


আকাশে ওই চাঁপা রঙের রোদ আর পেঁজা তুলো মেঘ দেখলে
, আজও মন উন্মনা হয়ে যায়। আর আমাদের ছোটবেলায় যে সমস্ত পুজাবার্ষিকী আমরা গোগ্রাসে গিলেছি তার অলংকরণ নিয়ে আলোচনা এবং সেগুলি দেখতে দেখতে বয়স কখন যেন কমে যাচ্ছিল। এখনও মনে পরে ১৯৭৮ সালে ক্লাস ওয়ান এ পড়ার সময় বাবা বাড়িতে নিয়মিত আনন্দমেলা আনার ব্যবস্থা করেছিলেন, তখন পরেশ দাদু বাড়িতে এসে বই দিয়ে যেতেন। সঙ্গে ইন্দ্রজাল কমিকস। পড়ার অভ্যেস কম ছিল, কিন্তু ছবি দেখার অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরে যখন বন্ধুদের মধ্যে বই আদান প্রদান আরম্ভ হয়ে কিশোরমন, শুকতারা এগুলো হাতে হাতে ঘোরাফেরা শুরু করে এবং বইয়ে উল্লিখিত সেই খেলার মতই আমাদের মধ্যে চালু হয়ে গিয়েছিল অলংকরণ দেখে শিল্পীর নাম বলা। সুধীর মৈত্র, বিমল দাস, নারায়ণ দেবনাথ, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, অনুপ রায়, সমীর সরকার, দেবাশীস দেব তখন আমাদের ঘরের শিল্পী হয়ে গেছেন।

কিন্তু যে শিল্পীদের নামের পরিচয় আগে দেওয়া হত না, যারা অলংকরণ করতেন তাদের অবস্থা কী ছিল সেই বিষয়ে এক ধারণা এই বইতে পাওয়া যাবে। সুবোধ দাশগুপ্তের কথায়, ও পুজো এসে গেছে! শুনে নায়ক সিনেমার মুকুন্দ লাহিড়ীর কথা মনে পড়ে। কিন্তু মুকুন্দ লাহিড়ী যখন সামিটে ছিলেন সেই অর্থ ভাগ্য কী এদের ছিল? উত্তর না। পুজোর গল্প আর ছবি আঁকার প্রক্রিয়া নিয়ে সুব্রত চৌধুরী আর কৃষ্ণেন্দু চাকীর অভিজ্ঞতাও এক প্রাপ্তি। অসম্ভব সুন্দর এই বইতে প্রচুর শিল্পীর কথা আর তাদের আঁকা প্রচুর ছবির কথা জানা যায়। কথার প্রসঙ্গেই ছবি এসেছে প্রচুর। আমাদের জন্মের আগের প্রচুর শারদীয়ার ছবি দেখার সুযোগ করে দিয়েছে এই বই। শুধু সেগুলি দেখার জন্যও এই বই কেনা যায়। কোন গুরুগম্ভীর আলোচনা নয়, একটা মন ছুঁয়ে যাওয়া তিরতির স্রোতের মত এক স্মৃতিকাতরতাও এই বইয়ের আরেক সম্পদ।