Tuesday 5 March 2024

বইয়ের দুনিয়া

 



বইয়ের দুনিয়া


সেটা বোধহয় ২০০৫ সালের কথা
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ মানেই বইমেলার শুরু আর প্রায় পনেরো বছর ধরে বা বেশীও হতে পারে এই বইমেলার সময় বিশেষ সংখ্যা বার করে দেশ পত্রিকা প্রথমের দিকে বইমেলা সংখ্যা নামে না থাকলেও পরবর্তীতে এই নাম চালু হয়ে যায় এই পত্রিকার পাঠকমাত্রই জানেন যে বই সম্বন্ধীয় লেখা আর বইয়ের বিজ্ঞাপণের জন্য এই সংখ্যাটি বই পড়ুয়াদের বিশেষ পছন্দ

তা পাড়ার মুখে গেছি, আমাদের ছোটকাদার কাগজের দোকানে, দেখি এক ছোট বই, নাম বইয়ের দেশ আমি ভাবলাম বোধহয় বই সংখ্যা ছোট হয়ে বেরিয়েছে কিনে বাড়ি নিয়ে গেলাম বেশ অন্য রকম বই বই নিয়ে প্রায় দু তিন পাতা আলোচনা, বিশাল সাক্ষাৎকার, শেষের দিকে সদ্য প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য বইয়ের তালিকা, প্রকাশক ও মূল্য সহ এর কিছুদিন পরেই দেশের নিয়মিত বই সংখ্যা বের হয় আমরা বই নিয়ে এক নতুন পত্রিকা উপহার পেলাম চেষ্টা করেছি প্রত্যেকটা পত্রিকা রাখার একটা অনলাইন সংখ্যা বাদ দিয়ে সবকটি সংখ্যাই সম্ভবত আছে

এতগুলো কথা বলতে হল একটা ঘটনায় আমি সেদিন জানুয়ারির প্রথমে সন্দীপ দাশগুপ্তের পুজোসংখ্যার অলঙ্করণ বইটি কিনে পড়েছি পড়ে এক রাশ ভালোলাগার কথাই জানিয়েছিলাম ফেসবুকে পরদিন সকালে আমার ফেসবুক বন্ধু পার্থ মুখোপাধ্যায় মেসেঞ্জারে জানালেন, লেখাটি একটি বইয়ের পত্রিকার জন্য চাই অনুমতি চান আমি সানন্দে অনুমতি দিলাম বললেন বইমেলা সংখ্যায় লেখাটি বেরোবে

একটু পরেই তিনি পত্রিকার এক পিডিএফ পাঠালেন হোয়াটসঅ্যাপে পত্রিকার নাম বইয়ের দুনিয়া নভেম্বর মাসের সংখ্যা মূল্য দশ টাকা ট্যাবলয়েড গোত্রের আটপাতার পত্রিকা এরপর বইমেলা শুরু হয়েছে, নানান কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি শেষের দিন পার্থবাবুর ফোন, বই মেলায় আসুন পত্রিকা নিয়ে যান তা যাওয়া হয়ে ওঠে নি, পরে আমার শ্যামবাজারের লক্ষণদার দোকানে পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন পত্রিকা কেমন লাগলো তাও জানাতে বলেনআলস্যতাবশত এবং কাজের চাপে তা হয়ে ওঠেনি তাই ছোট করে একটু জানিয়ে দিই

এই পত্রিকার নাম আগে জানতাম না সে আমার অজ্ঞানতা বইমেলা সংখ্যাটি জানুয়ারি মাসের পৃষ্ঠা সংখ্যা কুড়ি পাতার ডান দিকের কলমে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পুরস্কার প্রাপ্তির খবর পাশেই টিম বুচারের ব্লাড রিভার বইটি নিয়ে সুবীর কুমার ঘোষের আলোচনা, নীচেই এডওয়ার্ড লিয়ার কে নিয়ে শেখর বসুর লেখা

ফারসি কবিতা নিয়ে বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তীর লেখা রাধাপ্রসাদ গুপ্ত কে নিয়ে বা তার কলকাতার শব্দ নিয়ে সরজিৎ সেনগুপ্তের প্রবন্ধ পুরনো কথা মনে করিয়ে দেয় অন্বয় গুপ্তের - যে শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে আলোচনা হয় না বলে দু পাতা জোড়া প্রবন্ধটি পত্রিকার সম্পদ নতুন বই শীর্ষনামে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের গৌতম বুদ্ধের পথ ধরে, গৌতম মিত্রের প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত নিয়ে নিজেরাই আলোচনা করেছেন মনে পড়ে শীর্ষক আলোচনায় বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে বলেছেন, ছবিও তাঁর আঁকা 

আরো অনেক আলোচনার মধ্যে আমার লেখাটি স্থান পেয়ে নিয়েছে পত্রিকার পাতায় লেখাটা দেখার পর বুঝেছি লেখাটি একটু বড়ই হয়ে গেছে যারা লেখাটি ধৈর্য ধরে পড়েছেন এবং সম্পাদকীয় দপ্তর যারা লেখাটি মনোনয়ন করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই।


অনেক বছর পরে কাগজের পাতায় নিজের নাম দেখতে পেয়ে ভালোই লেগেছে কিন্তু বাবার নাম দেখে আমার পুত্র সন্তানের আনন্দই আমার বড় প্রাপ্তি


বইয়ের দুনিয়া
জানুয়ারি ২০২৪
মূল্যঃ ২০.০০ টাকা

Wednesday 3 January 2024

পুজোসংখ্যার অলংকরণ
পুজোসংখ্যার অলংকরণ
সন্দীপ দাশগুপ্ত
প্রতিক্ষণ
মূল্য ২০০.০০

খু মন খারাপ ভালো করার এক ওষুধ আমি আবিষ্কার করেছিলাম শিলিগুড়ি থাকাকালীন। তখন খবরের কাগজের কাজে একা থাকি অফিস মেসে। সেই সময় পরপর কয়েকটি ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যায় আমার কলকাতার জীবনে। কিন্তু সেখানে আমি অনুপস্থিত, ফলে কিছু করার নেই, ফেরার উপায় নেই। সেই সময় আমার কাজ শুরু হত, অন্যান্য কাগজের মতই বিকেলের দিকে, ফলে সারা সকাল-দুপুর এক অসহ্য সময় কাটাতে হয়েছে।
আগেও গেছি, তা একদিন বেরিয়ে আশুতোষ মুখার্জি রোডে আনন্দ পাবলিশার্সের দোকানে চলে গেলাম। ঘন্টা তিনেক কাটিয়ে দেখলাম, ওই সময়টুকু আমার কোন মন খারাপের কথা মনে হয়নি। এর পর কয়েকদিন একইভাবে আনন্দের দোকানে চলে গেছি, পরিচয় ভালোই হয়ে গিয়েছিল। কোনদিন ভদ্রলোক (লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি, নাম ভুলে গেছি) কোনদিন তার স্ত্রী দোকানে থাকতেন।  দোকান বন্ধ থাকলেও ফোন করে গেলে নিজে এসে খুলে দিতেন। তার মানে এই নয় যে আমি প্রতিদিন বই কিনতাম, আসলে আমার বইয়ের সান্নিধ্য ভালো লাগত, আমি ভুলে থাকতে পারতাম আমার দুঃখের কথা। যে দিন বাধ্য হয়ে শিলিগুড়ি ছেড়ে চলে আসি, সেইদিন অনেকগুলি বই কিনে, কিছু বাকি টাকা ফেরত দিয়ে কলকাতা ফিরেছিলাম।

এই সেদিন হঠাৎ এক মৃত্যুর খবরে আমার মন তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমে কথাটা রেজিস্টারই করেনি। যখন করল তখন একই সঙ্গে মন ও শরীর দুটোই বেশ বিদ্রোহ করে উঠল। তারপর ডাক্তার-বদ্যি, ওষুধপথ্য। দুদিন শয্যাশায়ী। তারপর সেই পুরনো ওষুধ ব্যবহার করলাম। নেমে পড়লাম কলেজ স্ট্রিটে। প্রতিক্ষণ  এর দোকানে আসা হয়নি কোনদিন। গিয়ে ঢুকে পড়লাম। সুন্দর সাজানো গোছানো বইয়ের দোকান, কয়েকজন ক্রেতাও আছেন। নানান প্রকাশনের একটু হটকে বইয়ের খনি দোকানটা। আছে বাংলাদেশের বই। প্রচুর আর্টপ্রিন্ট, যোগেন চৌধুরীর নোট বুকের ফ্যাক্সিমিলি। ছোটখাট হ্যান্ড ক্রাফটেড নোটবই ও অন্যান্য। এক কাপ সুন্দর চা এর মধ্যেই পরিবেশন হয়ে গেছে।
এর মধ্যেই আমি জেনেছি, সন্দীপ দাশগুপ্তের বই বেরিয়েছে। বইয়ের বিষয়বস্তু অলংকরণ। এর মধ্যেই রোচিষ্ণু তার পোস্টে মজা করিয়া পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও বলে যে ভাবে হাক পেড়ে পোস্ট দিয়েছে তাতে তো ভেবেছি যে বই আর পাওয়া হল না। তা গিয়ে দেখি বই আছে, আগেই একটা বগলদাবা করে অন্যান্য বই দেখে বাড়ি ফিরলাম।


দোকানে গিয়ে তো বইটা এক ঝলক দেখেছি, কিন্তু বাড়ি এসে জলখাবার আর চা খেতে খেতে বইটা অর্ধেক শেষ। তারপর রাত্রির খাবারের আগেই পুরো শেষ। তাঁর বাবা সুবোধ দাশগুপ্ত কে নিয়ে নানান পোস্ট পড়েছি, শিশির মঞ্চে বন্ধু শান্তনু সাহার পরিচালনায় দেখা হয়ে গেছে কলমিলতা ও কাঁচডানার গল্প। বাবাকে নিয়ে হাওড়া ও একাডেমিতে দুটো প্রদর্শনীও করেছেন তিনি। দুটোই দেখেছি গিয়ে।
সন্দীপ বাবুর কিছু লেখা আগে ফেসবুকে পড়েছি। তার ভাষা সচল, টিবি স্যানিটোরিয়াম নিয়ে এক লেখা পড়ে আমার রেমার্কের একটা লেখার কথা মনে হয়েছিল। যাই হোক, বইয়ের কথায় আসি, লেখা শুরু হয়েছে এইভাবে, পুজোসংখ্যার অনুরাগী হওয়ার জন্য খুব যে দেবদ্বিজে ভক্তি থাকার দরকার পড়ে এমন তো নয়। বাঙালি হওয়ার দরকার পড়ে। ……”


আকাশে ওই চাঁপা রঙের রোদ আর পেঁজা তুলো মেঘ দেখলে
, আজও মন উন্মনা হয়ে যায়। আর আমাদের ছোটবেলায় যে সমস্ত পুজাবার্ষিকী আমরা গোগ্রাসে গিলেছি তার অলংকরণ নিয়ে আলোচনা এবং সেগুলি দেখতে দেখতে বয়স কখন যেন কমে যাচ্ছিল। এখনও মনে পরে ১৯৭৮ সালে ক্লাস ওয়ান এ পড়ার সময় বাবা বাড়িতে নিয়মিত আনন্দমেলা আনার ব্যবস্থা করেছিলেন, তখন পরেশ দাদু বাড়িতে এসে বই দিয়ে যেতেন। সঙ্গে ইন্দ্রজাল কমিকস। পড়ার অভ্যেস কম ছিল, কিন্তু ছবি দেখার অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরে যখন বন্ধুদের মধ্যে বই আদান প্রদান আরম্ভ হয়ে কিশোরমন, শুকতারা এগুলো হাতে হাতে ঘোরাফেরা শুরু করে এবং বইয়ে উল্লিখিত সেই খেলার মতই আমাদের মধ্যে চালু হয়ে গিয়েছিল অলংকরণ দেখে শিল্পীর নাম বলা। সুধীর মৈত্র, বিমল দাস, নারায়ণ দেবনাথ, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, অনুপ রায়, সমীর সরকার, দেবাশীস দেব তখন আমাদের ঘরের শিল্পী হয়ে গেছেন।

কিন্তু যে শিল্পীদের নামের পরিচয় আগে দেওয়া হত না, যারা অলংকরণ করতেন তাদের অবস্থা কী ছিল সেই বিষয়ে এক ধারণা এই বইতে পাওয়া যাবে। সুবোধ দাশগুপ্তের কথায়, ও পুজো এসে গেছে! শুনে নায়ক সিনেমার মুকুন্দ লাহিড়ীর কথা মনে পড়ে। কিন্তু মুকুন্দ লাহিড়ী যখন সামিটে ছিলেন সেই অর্থ ভাগ্য কী এদের ছিল? উত্তর না। পুজোর গল্প আর ছবি আঁকার প্রক্রিয়া নিয়ে সুব্রত চৌধুরী আর কৃষ্ণেন্দু চাকীর অভিজ্ঞতাও এক প্রাপ্তি। অসম্ভব সুন্দর এই বইতে প্রচুর শিল্পীর কথা আর তাদের আঁকা প্রচুর ছবির কথা জানা যায়। কথার প্রসঙ্গেই ছবি এসেছে প্রচুর। আমাদের জন্মের আগের প্রচুর শারদীয়ার ছবি দেখার সুযোগ করে দিয়েছে এই বই। শুধু সেগুলি দেখার জন্যও এই বই কেনা যায়। কোন গুরুগম্ভীর আলোচনা নয়, একটা মন ছুঁয়ে যাওয়া তিরতির স্রোতের মত এক স্মৃতিকাতরতাও এই বইয়ের আরেক সম্পদ।

Wednesday 20 December 2023

লেভ ইয়াসিন কার্তিকদা



লেভ ইয়াসিন কার্তিকদা

     কার্তিকচন্দ্র মণ্ডল। 

     আমাদের কার্তিকদা।

    আশে পাশের পাড়া সহ আমাদের পাড়ায় যত ফ্ল্যাট হয়েছে, সেইগুলো সেকালে খেলার মাঠ ছিল, সবগুলো মাঠেই খেলা হত। আমাদের ছোটবেলায় আমরা প্রায় সব কটা মাঠেই খেলেছি। খেলোয়ার হিসেবে কোনো পেলু ছিলাম না, কিন্তু আমাদের মধ্যে খেলাধুলার চল ছিল। সবাই অন্তত খেলা ধূলো করত। পাড়ায় খেলার চল ছিল, গরমকালে ফুটবল, শীতকালে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, গাদি, খো খো  ইত্যাদি। ম্যাচ দেওয়া হত, টিম এসে খেলত, গিয়ে খেলা হত। পাড়ায় পাড়ায় নাম করা টুর্নামেন্ট হত। অন্যান্য সব পাড়ার মত আমাদের পাড়ায় ফুটবল খেলা চলত, টুর্নামেন্ট হত। ভালো স্ট্রাইকার ছিল, গোলকিপার ছিল। টুলুদা, ঝন্টুদার মত অনেকেই অকালে চলে গেছে। টুলুদা, ঝন্টুদা দারুণ স্ট্রাইকার ছিল। টুলুদার ব্যাকভলি, ঝন্টুদার হেড এখনও চোখে লেগে আছে। আর গোলকিপার অসিতদা, কার্তিকদা। কার্তিকদার চেহারার জন্য পাড়ায় তখন লেভ ইয়াসিন নামে খ্যাতি ছিল।

  তারপর যা হয়। বয়স বাড়ে, মাঠ কমে। সি আই টি-র জমিগুলি একে একে কো-অপারেটিভের গল্প দেখিয়ে ফ্ল্যাট হয়ে গেল। এক একটা মাঠের নাম পালটে এপার্টমেন্টের নামে এখন শোভা পায়। অঞ্চলের ইতিহাস ভূগোল ধীরে ধীরে পালটে গেল। লোমহীন ঘেয়ো কুত্তার মত কয়েকটা ঘাসহীন ধুলোবালি ভর্তি মাঠ পরে রইল। ইট-বালি-কংক্রিট-বাঁশের কাজের ফাঁকে যখন ফাঁকা থাকে, তখন খেলে যায় সবুজ বাচ্চাগুলো।

   এরপর জীবনের বাধ্যবাধকতায় কাজের মধ্যে ঢোকা গেল। তখন বিধাননগর রোড স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদহ গিয়ে বজবজ লোকাল ধরতে হত। তখন প্রায় শিয়ালদহে ট্রেন থেকে একসঙ্গে নেমে দক্ষিণ শাখা অবধি গল্প করতে করতে যাওয়া হত কার্তিকদার সঙ্গে। তখন জানি কার্তিকদা রেলে কাজ করে। তারপর আমি ওই কাজ ছাড়ার পর আর নিয়মিত দেখা হত না। দেখা হত পাড়ায়।

       এখন প্রায় রবিবার সকালে দেশবন্ধু পার্কে আমাদের দেখা হয়। এর মধ্যেই এক ব্যাপার ঘটে গেছে। প্রায় সবকটা নামকরা কাগজে কার্তিকদার নাম লেখা হয়েছে। ইন্টারনেটের দৌলতে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা মাধ্যমে খবরটি ভাইরাল হয়েছে।

     


ছবি সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা

কার্তিক দা মেট্রো রেলের গাড়ির চালক হিসেবে অনেকদিন কাজ করেছে। শেষে তার কাজ ছিল মেট্রো রেলের জি এমের গাড়ি চালক হিসেবে। ছোটবেলার গোল কিপারের দক্ষতার মত সেই কাজেও অত্যন্ত সফল ছিল কার্তিকদা। লেভ ইয়াসিনের মত সূক্ষ্মতায় গাড়ি চালিয়ে গেছে সে। গত ৩১শে অক্টোবর ছিল কার্তিকদার কাজের শেষ দিন। মেট্রো রেল ভবনে বিদায় সম্বর্ধনা দেওয়া হয় কার্তিকদাকে। কিন্তু সব থেকে চমকে দেন মেট্রো রেলের জি এম (জেনারেল ম্যানেজার) পি উদয়কুমার রেড্ডি। অনুষ্ঠান শেষে নিজের গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ধরেন তিনি তার দীর্ঘদিনের ড্রাইভারের জন্য। বলে উঠলেন, আজ আপনি পেছনের সিটে, আমি ড্রাইভার। নিজে স্টিয়ারিং ধরে প্রতিদিনের চলার রাস্তার উল্টোদিকে চালিয়ে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে দিলেন কার্তিকাদা কে কার্তিকদার পাড়ায়, তেলেঙ্গাবাগানে।

     সময় বদলেছে, আমরা এখন বেঁধে বেঁধে থাকি না। পাড়ার পুরনো মানুষ কমে যাচ্ছে। কেউ কোন খবরও রাখে না। আমার অঞ্চলের অনেক মানুষই দেখলাম খবরটা জানত না। তাই তাদের জানার জন্য এই লেখা। নিচে যতগুলি কাগজের পেলাম লিঙ্ক দিলাম।

 

আনন্দবাজার পত্রিকা

https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/gm-of-kolkata-metro-rail-drives-for-his-driver-on-retirement-day-dgtl/cid/1471319

 THE STATESMAN

https://www.thestatesman.com/bengal/farewell-gesture-metro-gm-drives-to-drop-driver-home-1503236937.html

 X

https://twitter.com/SeemaSengupta5/status/1720505743336702256


কয়েক মাস ধরেই অনেকগুলি ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কিছুই লেখা হয় নি। তাই ভাবলাম এক এক করে লিখে ফেলি। আজ একটা।


Thursday 25 August 2022

 

লেমন কার্ডে মাখো মাখো চিকেন রান্না

পোড়া দেখালেও, স্বাদে অতুলনীয়

ছবি ও লেখা: ক্লেয়ার লোয়ার



বড় হওয়া ইস্তক আমাকে একমাত্র গরুখোরই বলা যায়, আর পছন্দের মাংস হিসেবে শুয়োর দ্বিতীয় দলেই থাকবে। মুরগীর মাংস নিয়ে আমি সেরকম সময় ব্যয় করতাম না যদি না ব্যাটার করা বা ফ্রাই করা পেতাম। আমি ভাবতাম মুরগীর মাংস স্বাদহীন, বিরক্তিকর পথচারীর মত। একজন দক্ষ্ম রাঁধুনি মুরগীর মাংসের স্বাদ দারুণ ভালো করতে পারেন, কিন্তু একজন সৃষ্টিশীল রাঁধুনি তার স্বাদ নিয়ে যেতে পারেন অকল্পনীয়তায়। আলি স্লেগল ঠিক সেইরকমই এক সৃষ্টিশীল রাঁধুনি। আর ওঁর ক্যারামেল মাখানো লেমন কার্ড চিকেন সেই রকমই এক উচ্চস্তরের খাদ্য।

টিকটকে প্রকাশ করা ওঁর রন্ধন প্রণালীটা খুব সাধারণ, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত। কোন লেবু ছাড়াই লেবু চিকেন। একটা মুরগী ছাড়িয়ে, অনেকদিনের রাখা লেমন কার্ড চামড়ার তলায় জোর করে ঢুকিয়ে, বাকিটা শরীরের উপর মাখিয়ে দেন। এরপর মাংসটিকে ওভেনে ৪০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে ঝলসাতে থাকেন যতক্ষণ না থাইয়ের মাংস ১৬৫ ডিগ্রিতে না গিয়ে পৌঁছয়। একদম সোজা।

প্রথম প্রথম মনে হতেই পারে খুব মিষ্টি একটা চিকেনের পদ তৈরি হয়েছে। দইতে যেহেতু প্রচুর চিনি থাকে আর চিনির অনেক অংশই ক্যারামেলাইজড হয়ে যায় বা, আমার ক্ষেত্রে যেমন একটু পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

আমি এই পদটি রান্না করতে খুব উৎসাহী ছিলাম, কিন্তু দুটো জিনিসের জন্য আমি গোটা চিকেন রান্না করা থেকে পিছিয়ে এলাম। এক আমার কমজোরী এয়ার কন্ডিশনার আর দ্বিতীয় হল আমার লড়ঝড়ে ফ্রিজ। আমার এসি এই আবহাওয়ার জন্য একটুও উপযোগী নয় আর ৪০০ ডিগ্রি ওভেনে মাংস চাপানো আমার কাছে খুব সুবিধাজনক মনে হচ্ছিল না। তো আমি কিছু মাংসের টুকরো বেছে নিলাম যা আমার এয়ার ফ্রায়ারে ব্যবহার করা যায়। একইসঙ্গে আমি এখন একটা ছোট ফ্রিজ ব্যবহার করছি, তাতে একটা গোটা মুরগী রাখার থেকে দুটো অবশিষ্ট থাই রাখা বেশি সুবিধাজনক।

যাইহোক,

আমি এই রান্নার প্রণালীতে গোটা মুরগী থেকে কমিয়ে চারটে থাইতে নিয়ে এসেছি। তারপর টিকটক ভিডিওতে যেমন দেখিয়েছে সেই ভাবে আমি মুরগীর টুকরো গুলোর চামড়ার তলায় জোর করে দই ঠুসেছি আর ওপরে চপচপে করে ভিজিয়েছি। আমি প্যানে জল দিই নি, কারণ এয়ার ফ্রায়ারে জল ব্যবহার করা যায় না। বাদবাকি রান্নাটা প্রায় একই রেখেছি। আমি এর পর এয়ার ফ্রায়ারে ৪০০ ডিগ্রী ফারেনহিটে থাইগুলোকে ঝলসেছি। যা একটু বেশীই হয়েছে, তার কারণ চামড়া গুলো ভীষণ কালো হয়ে গিয়েছিল।

আমার এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ ঘটেনি, কেননা, আমি এত ভালো থাইয়ের পিস এর আগে কোনদিন চেখে দেখিনি। মাংস একদম তুলতুলে, চামড়া পুড়ে কালো হলেও তিঁতকুটে হয়নি। (তবে আমি বলব পোড়ানো নিজের আয়ত্তে রাখার জন্য তাপমাত্রা কমিয়ে ৩৫০ ডিগ্রিতে নিয়ে আসা ভালো) ।

রেস্টুরেন্টে গেলে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমনি দেখতে একইরকম উজ্জ্বল, আর মাংস সহ সবকিছু থেকে তৈরি হওয়া ঝোল মিষ্টি, আঠালো এবং সুগন্ধ যুক্ত। চামড়ার নিচের দই মাংসের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার ফলে তা অত্যন্ত রসালো এবং সুস্বাদু হয়েছে। রান্না নামিয়ে আমি দুটো থাই আমি দ্রুত গলাধঃকরণ করে ফেলেছি।

এই রন্ধন প্রণালী একদম ঠিক ঠাক, তবে সামান্য কিছু দিয়ে অবশ্যই একটু অন্যরকম করাই যায়। লালমরিচ দিয়ে বেশ কান গরম করা, বা জিরে দিয়ে একটু স্বাদ বদল করা, অথবা অ্যাজিনোমোটো দিয়ে আরো মাংসল গন্ধ বার করার জন্য। তবে আপনি অবশ্যই রান্না করতে একটা গোটা চিকেন নেবেন এবং দই মাখাবেন। আর ছোট করে শুরু করার পক্ষে চিকেন এর থাই অত্যন্ত উপযোগী।



লেমন কার্ড চিকেন থাই

উপকরণ:

  • ·         চামড়া, হাড় সহ চিকেন থাই (চার টুকরো)
  • ·         ১/৪ কাপ লেমন কার্ড
  • ·         ২ চা চামচ নুন, দু ভাগে
  • ·         ১/২ চা চামচ সাদা গোলমরিচ
  • ·         জলপাই তেল

ওভেন কে আগেই ৪০০ডিগ্রি ফারেনহাইটে রাখুন। আর এয়ার ফ্রায়ার ব্যবহার করলে আগে চিকেন কে সম্পূর্ণ দই দিয়ে মাখিয়ে নিয়ে তারপর ৩৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে রাখতে হবে। (না হলে আমার রান্নার মত চামড়া পুরো কালো হয়ে যাবে।)

এক চা চামচ নুন এবং সাদা গোলমরিচ দিয়ে দইটা খুব ভালো ভাবে মেশান। বাকি নুন এবং গোলমরিচ (যদি ঝাল পছন্দের হয়, তবে আরও একটু মরিচ ছড়িয়ে দিতে পারেন) দিয়ে থাইগুলো মাখিয়ে নিন। দই মিশ্রিত মিশ্রণটির ৩/৪ অংশ জোর করে চামড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে নিন। তারপর বাকিটা থাইয়ের গায়ে ভালো করে মাখিয়ে দিন। এরপর যদি এয়ার ফ্রায়ার ব্যবহার করেন, তাহলে থাইগুলো ওর বাস্কেটে রাখতে পারেন, বা অন্যভাবে একটা রোস্টিং প্যানে ১/৪ কাপ জল দিয়ে মাংসগুলি ছড়িয়ে দিন। থাইগুলির ওপরে সামান্য জলপাই তেল ছড়িয়ে দিয়ে ভিজিয়ে দিন।

যদি এয়ার ফ্রায়ারে রান্না করেন, তাহলে ১৫ মিনিট ধরে বা একটু বেশি ৩৫০ ডিগ্রিতে রান্না করুন, যতক্ষণ না সবথেকে মোটা অংশ ১৬৫ ডিগ্রিতে গিয়ে পৌঁছায়। আর যদি ওভেন ব্যবহার করেন, ৪০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে রোস্ট করুন যতক্ষণ না ওই মোটা অংশগুলি ওই তাপমাত্রায় গিয়ে পৌঁছায়।

সামান্য লেবুর রস ছড়িয়ে দিয়ে দ্রুত সার্ভ করুন। 

Saturday 16 March 2019

শার্লক হোমস অনুবাদ



শার্লক হোমস অনুবাদ।


প্রায়ই নানান গ্রুপে অনেকেই জানতে চান শার্লক হোমসের কোন অনুবাদটা ভালো। বাজারে এত খারাপ খারাপ অনুবাদ বইজাত হয়ে বিক্রি হচ্ছে যে বাধ্য হয়ে এই পোস্টটি দিচ্ছি। এই বিষয়ে শার্লক হোমসের A Scandal in Bohemia-র একটা অনুচ্ছেদ তুলে ধরছি মূল ইংরাজিতে। এর অনুবাদ হওয়া বইগুলির একটি করে পাতা তুলে দিচ্ছি। কোনটা ভালো বা কোনটা খারাপ পাঠক নিজেই বুঝে নেবেন।




১। বাজার চলতি সমগ্রের মধ্যে সবচেয়ে দামী, লালমাটি প্রকাশিত শার্লক হোমস সমগ্র। এককালে বেঙ্গল পাবলিশার্স পাঁচ খণ্ডে বার করেছিলেন। এখন সটীক। সৌম্যেন পাল ও প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত-র সম্পাদনা করা।  তবে অনুবাদটি পড়লেই বোঝা যায় এটি সম্পুর্ণ অনুবাদ নয়। পাঁচ লাইনেই প্রথম অনুচ্ছেদ সমাপ্ত। পাঠকের জানা উচিত এই বইটি সম্পূর্ণ অনুবাদ নয় বরং সংক্ষেপিত।

২। দ্বিতীয় বইটি তুলি-কলম প্রকাশিত শার্লক হোমস অমনিবাস। অনুবাদ মণীন্দ্র দত্ত। চার খণ্ডে সম্পুর্ণ। বর্তমানে একখণ্ডে পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ অনুবাদ।



৩। তৃতীয় বইটি আমার ব্যক্তিগত পছন্দের। আমার দ্বিতীয় হোমসের বই। শার্লক হোমস সমগ্র। অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির। বিভিন্ন জনের অনুবাদ। সম্পাদনা অমিয়কুমার চক্রবর্তী। সম্পুর্ণ অনুবাদ। বর্তমানে পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে এটিরও একটি অখণ্ড সংস্করণ বের হয়।


এর বাইরে সম্পূর্ণ হোমস বলে যে অনুবাদগুলি বাজারে চলছে তার দু একটি নমুনা দিয়ে দিলাম। কী রকম অনুবাদ, আপনারা নিজেরাই বুঝে নিন।

























সমগ্রর বাইরে আর যে বইটি খুব বিখ্যাত, সুভদ্রকুমার সেনের অনুবাদে, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত। ভালো অনুবাদ। কিন্তু দেখবেন এই গল্পের ক্ষেত্রে প্রথম অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে গল্পটি শুরু হচ্ছে।


আরেকটি বই দ্য এ্যাডভেঞ্চার্স  অফ শার্লক হোমস। আদিত্য প্রকাশালয়ের। সুবোধ চক্রবর্তীর অনুবাদ। আমার বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু বইটিতে মাত্র পাঁচটি গল্প আছে।


অতএব অনুবাদ কেনার সময় একটু বেছে কিনবেন।

#Sherlock Holmes

Tuesday 12 March 2019

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জন্মদিন পালন


তিরিশ বছর আগে জন্ম নিয়েছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। ১৯৯৩ সালে তা সাধারণ মানুষের ব্যবহারে আসে। আমরা ব্যবহার শুরু করি ১৯৯৯ সালে। যারা এই বিষয় জানতেন তারা একটা বাংলা নামও দিয়েছিলেন। জগৎ জোড়া জাল। আমরা বেরিয়েছিলাম ইন্টারনেটে দুর্গাপুজা দেখাতে। বিজ্ঞাপণ আনতে গিয়ে শুনতে হয়েছে, ভাই ইন্টারনেটটা কী? খায় না মাথায় দেয়? পরিচিত, বন্ধুবান্ধব রাও ঠেস দিয়ে কথা বলত। আমাদেরই একজন বলেছিল হেঁটে নয় নেটে। লিখে ফেললাম আমন্ত্রণপত্র, যা দেবি ইন্টারনেটেষু ডটকমরূপেণ সংস্থিতা... নমস্তেসৈ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে চন্দ্রবিন্দু গান লিখল, যা বেবি দৌড়ে যাবি, শিখবি মাল্টিমিডিয়া। দুনিয়া ডট কম। তখন ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপণ চাইতে গিয়ে মাসের পর মাস ঘুরেছি। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার-ফোর এ যা দেখা যায় তা থ্রি পয়েন্ট ওয়ানে তা দেখায় না। সদ্য তৈরি করা ফ্ল্যাশের অ্যানিমেশন এক মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির সাউথ এশিয়ান হেডের ল্যাপটপে ভেঙে ভেঙে আসছে। বোঝাতেই পারা যাচ্ছে না যে আপনার ব্রাউসার আপ টু ডেট নয়। এইরকম নানা কথা আজ মনে পড়ল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জন্মদিন পালন দেখে।

তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ এক কুড়ি বছর। আজ সবাই নেট বিনে কানা।

Tuesday 28 August 2018

অগোছালো বই, এলোমেলো পড়া






# অগোছালো বই, এলোমেলো পড়া - ১
আংলা-বাংলা।
লেখক : অমূল্যভূষণ পাল।
নিজের জন্য বই কেনা কয়েক মাস ধরে প্রায় বন্ধ। তার অন্যতম কারণ আমার দু বছর উত্তীর্ণ ছেলে আমাকে বই নিয়ে বসতে দেখলেই সেটা টেনে নিয়ে নিজে পড়তে বসে। মানে পড়ার চেষ্টা করে। ফলে যে বই নিয়েই বসি সেটা অসম্পূর্ণ অবস্থায় পরে থাকে। ফলে নিজের জন্য বই কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু বই কেনা বন্ধ করতে পারিনি। কিন্তু কেনাকাটা গুলো হয়ে পরেছে ছেলেকেন্দ্রীক। অস্বীকার করব না একই সঙ্গে নিজের ছোটবেলাকে ফেরত পাওয়ার বা

একবার ছুঁয়ে দেখার এক নেশাও এর মধ্যে মিশেছে।

এতটা ভূমিকা করার একমাত্র কারণ, ছেলের জন্য কেনা একটা ছড়ার বই। বইটির নাম আংলা-বাংলা। লেখক অমূল্যভূষণ পাল। আমি আগে দেখিনি। নামও শুনিনি। বইয়ের প্রচ্ছদটা আমাকে বইটা হাতে তুলে নিতে বাধ্য করল। কৃষ্ণেন্দু চাকীর আঁকা। ভেতরের প্রত্যেক পাতায় আঁকা ছবিও তাঁর।
বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, বাড়ির ছোটদের জন্য ইংরেজিতে লেখা ছড়া গুলো তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতেন। বাড়ির ছোটরা বড় হয়ে যেতে অনুবাদগুলি বাড়িতেই পরে ছিল। এর পর সত্যজিৎ রায়ের তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম প্রকাশিত হয়। তিনি উৎসাহের বশে অনুবাদগুলি সত্যজিৎ রায়ের কাছে পাঠান। তিনি জানান, এগুলি ছাপার প্রয়োজন আছে। কিন্তু বহু বছর কবিতাগুলি ছাপা হয়নি। অবশেষে ২০১২ সালে পরম্পরা প্রকাশন ছাপার উদ্যোগ নেয় এবং বইটি প্রকাশিত হয়।
মাত্র তিরিশ পাতার বই। মোট ছড়া আছে চব্বিশটা। প্রত্যেক পাতায় কৃষ্ণেন্দু চাকীর অলংকরণ। বাচ্চা সহ বড়দেরও ভালোলাগার। অনুবাদ খুব সুন্দর। একটা উদাহরণ দিই-

Humpty Dumpty sat on a wall,
Humpty Dumpty had a great fall;...


হিমপুটি ডিমফুটি বসেছিল পাঁচিলে
আচমকা কুপোকাত, কোথায় কে হাঁচিলে?...


মাত্র ২৪টি ছড়া আছে। তাই উদাহরণ আর দিচ্ছি না। অনুবাদ নিয়ে আলোচনাও করলাম না। কিনে নিয়েই পড়তে বলব সবাইকে। ভালো-মন্দ নিজেরাই ঠিক করে নেবেন আশা রাখি।


আংলা-বাংলা
লেখক অমূল্যভূষণ পাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ কৃষ্ণেন্দু চাকী
পরম্পরা
মূল্য ৪০.০০ টাকা।

Thursday 14 February 2013

আমার প্রতিবাদের ভাষা


আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন
…………………………………
করুক চূর্ণ ছিন্ন-ভিন্ন, শত ষড়যন্ত্রের জাল যেন
আনে মুক্তি, আলো আনে, আনে লক্ষ্য শত প্রাণে

আমি বলতে আমরা নিজেরা নিজেদেরকেই বোঝাই। কিন্তু আমি যখন একাকার হয়ে আমরা হয়ে যাই, আর যখন সেই আমরা একই কণ্ঠে একই কথা বলে উঠতে থাকি, তখন সেই ভাষা সর্বজনের কাছে আমার ভাষা হয়ে যায়।
গত আট দিন ধরে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের শাহবাগ স্কোয়্যারে সাধারণ যুবক যুবতীরা এক প্রতিবাদ মিছিলে জড়ো হয়ে আছেন। এই মিছিলের মূল উদ্যোক্তারা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। তাদের দাবী মুক্তি যুদ্ধের সমস্ত অপরাধীদের ফাঁসি চাই। এই আন্দোলন প্রথমে ফেসবুক এবং ব্লগের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং আস্তে আস্তে সমস্ত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দুই-এক দিন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে এই আন্দোলনের ছবি দেখলাম। আগের দিন এই সভা থেকে সারা বাংলাদেশে তিন মিনিটের জন্য নীরবতা পালনের ডাক দেওয়া হয়। গত কাল বিকেল ৪টে থেকে ৪টে ৩ মিনিট অবধি তিন মিনিটের জন্য সমস্ত বাংলাদেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ, মিডিয়া হাউস এবং একাত্তরের ভুক্তভোগী মানুষ,নানান স্তরে কর্মীরা বা আরও কেউ কেউ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ছে।
এই আন্দোলনের প্রধান মুখ এক দল শিক্ষিত সমাজ। যে সমাজ শিক্ষার আলোয় তাদের নতুন দুনিয়া দেখছেন। এই দুনিয়ায় মৌলবাদ নেই, ধর্ম নেই, কুসংস্কার নেই। নতুন নতুন স্লোগান উঠছে। ছবিতে, আঁকাতে, কবিতায়, গানে, নাটকে এর নানা রূপ দেখা যাচ্ছে। জয় বাংলা স্লোগান এখন সবার মুখে মুখে। ছন্দে মিল দিয়ে উঠছে আরও স্লোগান। স্কুলের ছাত্র, ইউনিভার্সিটির ছাত্র যাদের জন্মের অনেক আগেই মুক্তিযুদ্ধ ঘটে গেছে তারাও পথে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে নাকি এরকম জন জাগরণ আগে ঘটেনি।
কিন্তু যারা বিরোধী সেই জামাত এবং রাজাকার তারা আজও রয়ে গেছে। তাদের পরিচালিত সরকার প্রায় একুশ বছর শাসন করেছে। হয় নিজেরা নয় অধুনা বিরোধী দল বিএনপি-র সাথে। এখনও অবধি বিএনপি-র পক্ষ থেকে কিছুই বলা হয়নি। যাও বা বলা হয়েছে তা এই আন্দোলনের স্বপক্ষে নয়। কাল জামাত নানান জায়গায় ওই তিন মিনিট সময়ের মধ্যে গণ্ডগোল করার চেষ্টা করেছে। ইট-পাটকেল মেরেছে। এপার বাংলায় সেই ছবিও ছাপা হয়েছে। আজ একটি এপার বাংলার কাগজে দেখলাম বাংলাদেশের এই আন্দোলন একটু গুরুত্ব সহকারে ছেপেছে। একটি সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়েছে। তবুও ওপার বাংলার এই জন জাগরণ বা ভাল করে বললে বাঙ্গালির এই নতুন অভ্যুত্থান আরও গুরুত্ব সহকারে এপার বাংলায় প্রচারিত হওয়ার দাবি রাখে।
মৌলবাদীদের আধিপত্য অতি ভয়ঙ্কর, তা দল-মতবাদ-ধর্ম-রাষ্ট্র যারই হোক। তারা কখনোই চায় না মানুষ শিক্ষিত হোক। তারা চাইবে না মানুষ তার নিজের মতামত প্রকাশ করুক এবং তারা ভেবেই নেয় যে মানুষ তাদের অধীনস্থ থাকবে সারাজীবন। তাদের সেই আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োর বইয়ে যা লেখা থাকবে তাই ধ্রুব সত্য বলে ধরে থাকবে। জীবন-প্রকৃতি সবই যে পরিবর্তনশীল এবং গতিশীল এটা তারা সর্ব সমক্ষে স্বীকার করে না। কারণ তাতে তাদের বাজার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে। কিন্তু ব্যবহার করার সময় সমস্ত নতুন জিনিসই তাদের চাই। তাদের মাইক লাগে, ইট-কাঠ-কংক্রিট লাগে, তাদের নতুন ছাপাখানার প্রযুক্তি লাগে, লাগে টেলিভিশন চ্যানেল, মোবাইল ফোন, লাগে কালাশনিকভ রাইফেল, সাঁজোয়া গাড়ি। তাই আজ পাঁচশো বছর পর গ্যালিলিওকে স্বীকৃতি দেয় পোপ। অথচ সেই গ্যালিলিওকে সর্বসমক্ষে স্বীকার করতে হয়েছিল যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। সেই মানুষই বাইরে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন তবুও পৃথিবী চারদিকে ঘুরবে। মেঘনাদ সাহাকে শুনতে হবে সব ব্যাদে আছে। বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তি ভাঙ্গা হবে। মাস হিস্টিরিয়া তৈরি করে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হবে। কিউবা চল্লিশ বছর ধরে অবরোধে থাকবে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগানোর চেষ্টা করা হবে।
আজ থেকে একশো বছর আগে যা সত্যি ছিল তা আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে। আগে বিজ্ঞান ভেবেছিল মৌলের ক্ষুদ্রতম কণা হল পরমাণু, আজ যদি বিজ্ঞানীরা সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে ধরে বসে থাকতেন তাহলে আজ আর ঈশ্বর কণার খোঁজ চলত না। যেমন ভাবে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণা প্রাচীন যুগেই স্থবির হয়ে গেল। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষাগুলো মৃত হয়ে গেল। ধর্ম-মতবাদ যদি পরিবর্তনশীল না হয় তাহলে কালের যাত্রায় তারাও নিক্ষিপ্ত হবে কালের গর্ভে। কারণ মানুষ চিরকাল অশিক্ষিত থাকবে না।
তবুও এই আন্দোলন নিয়ে আমার কেমন শঙ্কা হচ্ছে। কায়রোর তাহরির স্কোয়্যার, দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে বিক্ষোভ, নন্দীগ্রাম পরবর্তী নাগরিক সমাজের মিছিল সবই কখন মাঝপথে হাইজ্যাক হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে আওয়াজ উঠেছিল যে ধর্ষণকারীদের জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক, একইরকম ঢাকায় আওয়াজ উঠছে কাদের মোল্লাকে শাহবাগ স্কোয়্যারে ছেড়ে দেওয়া হক। যারা সম্পূর্ণ শরীর মনে বিশ্বাস নিয়ে আন্দোলনে নামেন, তারা হঠাৎ দেখেন কখন যেন তাদের হাত থেকে ব্যাটনটা অন্য হাতে চলে গেছে। কিছু ছিদ্রান্বেষী মানুষ, স্বার্থপরের হাতে সেই নেতৃত্ব চলে যায়। কিছু ভালো নেতাও কী উঠে আসেন না, আসেন কিন্তু লক্ষ্য তখন সরে গেছে। সাতের দশকের নকশাল আন্দোলন কি শিক্ষিত সমাজের ছেলেদের দিয়ে তৈরি নয়। সেই আন্দোলনও তো আজ গবেষণার বিষয়। যে আন্দোলন সাধারণ মানুষের সাথে একাত্ম হতে পারে না তা বিফলে যেতে বাধ্য। জোর করে সেই মতবাদ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিলেও মানুষ এক না একদিন তার ফাঁস কেটে বেরিয়ে আসবে। তারপর দেখা যাবে আন্দোলনটা কবে যেন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আর সেই আন্দোলনের ব্যর্থ নেতারা সেই সুখের সময়ের জাবর কাটতে কাটতে ভুলেই যায় যে তারা কবে জীবন্ত মমি হয়ে গেছে।
তবুও কী আশা নেই। অবশ্যই আছে। বারবার যত এই রকম রক্তপাতহীন আন্দোলন পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠবে, ততবার এই নতুন আন্দোলন তার পুরনো আন্দোলনের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে। আর তত ভুল শুধরে এক নতুন সমাজ তৈরি হবে। সেই শিক্ষিত সমাজ ধর্ম, রাজনীতি, মিডিয়ার বেড়া ভেঙ্গে এক নতুন পথের দিশা দেবে। যেখানে একা মানুষ দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেবে এক নতুন বিপ্লবের। সেই তৈরি করবে খবর, আর তার খবর লাইক করবে, শেয়ার করবে সম মনো ভাবাপন্ন মানুষ জন। পৃথিবীর বুকে এই রকম আন্দোলন আরও আসুক নেমে।


১৩/০২/২০১৩