Thursday 14 February 2013

আমার প্রতিবাদের ভাষা


আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন
…………………………………
করুক চূর্ণ ছিন্ন-ভিন্ন, শত ষড়যন্ত্রের জাল যেন
আনে মুক্তি, আলো আনে, আনে লক্ষ্য শত প্রাণে

আমি বলতে আমরা নিজেরা নিজেদেরকেই বোঝাই। কিন্তু আমি যখন একাকার হয়ে আমরা হয়ে যাই, আর যখন সেই আমরা একই কণ্ঠে একই কথা বলে উঠতে থাকি, তখন সেই ভাষা সর্বজনের কাছে আমার ভাষা হয়ে যায়।
গত আট দিন ধরে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের শাহবাগ স্কোয়্যারে সাধারণ যুবক যুবতীরা এক প্রতিবাদ মিছিলে জড়ো হয়ে আছেন। এই মিছিলের মূল উদ্যোক্তারা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। তাদের দাবী মুক্তি যুদ্ধের সমস্ত অপরাধীদের ফাঁসি চাই। এই আন্দোলন প্রথমে ফেসবুক এবং ব্লগের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং আস্তে আস্তে সমস্ত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দুই-এক দিন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে এই আন্দোলনের ছবি দেখলাম। আগের দিন এই সভা থেকে সারা বাংলাদেশে তিন মিনিটের জন্য নীরবতা পালনের ডাক দেওয়া হয়। গত কাল বিকেল ৪টে থেকে ৪টে ৩ মিনিট অবধি তিন মিনিটের জন্য সমস্ত বাংলাদেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ, মিডিয়া হাউস এবং একাত্তরের ভুক্তভোগী মানুষ,নানান স্তরে কর্মীরা বা আরও কেউ কেউ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ছে।
এই আন্দোলনের প্রধান মুখ এক দল শিক্ষিত সমাজ। যে সমাজ শিক্ষার আলোয় তাদের নতুন দুনিয়া দেখছেন। এই দুনিয়ায় মৌলবাদ নেই, ধর্ম নেই, কুসংস্কার নেই। নতুন নতুন স্লোগান উঠছে। ছবিতে, আঁকাতে, কবিতায়, গানে, নাটকে এর নানা রূপ দেখা যাচ্ছে। জয় বাংলা স্লোগান এখন সবার মুখে মুখে। ছন্দে মিল দিয়ে উঠছে আরও স্লোগান। স্কুলের ছাত্র, ইউনিভার্সিটির ছাত্র যাদের জন্মের অনেক আগেই মুক্তিযুদ্ধ ঘটে গেছে তারাও পথে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে নাকি এরকম জন জাগরণ আগে ঘটেনি।
কিন্তু যারা বিরোধী সেই জামাত এবং রাজাকার তারা আজও রয়ে গেছে। তাদের পরিচালিত সরকার প্রায় একুশ বছর শাসন করেছে। হয় নিজেরা নয় অধুনা বিরোধী দল বিএনপি-র সাথে। এখনও অবধি বিএনপি-র পক্ষ থেকে কিছুই বলা হয়নি। যাও বা বলা হয়েছে তা এই আন্দোলনের স্বপক্ষে নয়। কাল জামাত নানান জায়গায় ওই তিন মিনিট সময়ের মধ্যে গণ্ডগোল করার চেষ্টা করেছে। ইট-পাটকেল মেরেছে। এপার বাংলায় সেই ছবিও ছাপা হয়েছে। আজ একটি এপার বাংলার কাগজে দেখলাম বাংলাদেশের এই আন্দোলন একটু গুরুত্ব সহকারে ছেপেছে। একটি সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়েছে। তবুও ওপার বাংলার এই জন জাগরণ বা ভাল করে বললে বাঙ্গালির এই নতুন অভ্যুত্থান আরও গুরুত্ব সহকারে এপার বাংলায় প্রচারিত হওয়ার দাবি রাখে।
মৌলবাদীদের আধিপত্য অতি ভয়ঙ্কর, তা দল-মতবাদ-ধর্ম-রাষ্ট্র যারই হোক। তারা কখনোই চায় না মানুষ শিক্ষিত হোক। তারা চাইবে না মানুষ তার নিজের মতামত প্রকাশ করুক এবং তারা ভেবেই নেয় যে মানুষ তাদের অধীনস্থ থাকবে সারাজীবন। তাদের সেই আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োর বইয়ে যা লেখা থাকবে তাই ধ্রুব সত্য বলে ধরে থাকবে। জীবন-প্রকৃতি সবই যে পরিবর্তনশীল এবং গতিশীল এটা তারা সর্ব সমক্ষে স্বীকার করে না। কারণ তাতে তাদের বাজার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে। কিন্তু ব্যবহার করার সময় সমস্ত নতুন জিনিসই তাদের চাই। তাদের মাইক লাগে, ইট-কাঠ-কংক্রিট লাগে, তাদের নতুন ছাপাখানার প্রযুক্তি লাগে, লাগে টেলিভিশন চ্যানেল, মোবাইল ফোন, লাগে কালাশনিকভ রাইফেল, সাঁজোয়া গাড়ি। তাই আজ পাঁচশো বছর পর গ্যালিলিওকে স্বীকৃতি দেয় পোপ। অথচ সেই গ্যালিলিওকে সর্বসমক্ষে স্বীকার করতে হয়েছিল যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। সেই মানুষই বাইরে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন তবুও পৃথিবী চারদিকে ঘুরবে। মেঘনাদ সাহাকে শুনতে হবে সব ব্যাদে আছে। বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তি ভাঙ্গা হবে। মাস হিস্টিরিয়া তৈরি করে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হবে। কিউবা চল্লিশ বছর ধরে অবরোধে থাকবে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগানোর চেষ্টা করা হবে।
আজ থেকে একশো বছর আগে যা সত্যি ছিল তা আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে। আগে বিজ্ঞান ভেবেছিল মৌলের ক্ষুদ্রতম কণা হল পরমাণু, আজ যদি বিজ্ঞানীরা সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে ধরে বসে থাকতেন তাহলে আজ আর ঈশ্বর কণার খোঁজ চলত না। যেমন ভাবে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণা প্রাচীন যুগেই স্থবির হয়ে গেল। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষাগুলো মৃত হয়ে গেল। ধর্ম-মতবাদ যদি পরিবর্তনশীল না হয় তাহলে কালের যাত্রায় তারাও নিক্ষিপ্ত হবে কালের গর্ভে। কারণ মানুষ চিরকাল অশিক্ষিত থাকবে না।
তবুও এই আন্দোলন নিয়ে আমার কেমন শঙ্কা হচ্ছে। কায়রোর তাহরির স্কোয়্যার, দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে বিক্ষোভ, নন্দীগ্রাম পরবর্তী নাগরিক সমাজের মিছিল সবই কখন মাঝপথে হাইজ্যাক হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে আওয়াজ উঠেছিল যে ধর্ষণকারীদের জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক, একইরকম ঢাকায় আওয়াজ উঠছে কাদের মোল্লাকে শাহবাগ স্কোয়্যারে ছেড়ে দেওয়া হক। যারা সম্পূর্ণ শরীর মনে বিশ্বাস নিয়ে আন্দোলনে নামেন, তারা হঠাৎ দেখেন কখন যেন তাদের হাত থেকে ব্যাটনটা অন্য হাতে চলে গেছে। কিছু ছিদ্রান্বেষী মানুষ, স্বার্থপরের হাতে সেই নেতৃত্ব চলে যায়। কিছু ভালো নেতাও কী উঠে আসেন না, আসেন কিন্তু লক্ষ্য তখন সরে গেছে। সাতের দশকের নকশাল আন্দোলন কি শিক্ষিত সমাজের ছেলেদের দিয়ে তৈরি নয়। সেই আন্দোলনও তো আজ গবেষণার বিষয়। যে আন্দোলন সাধারণ মানুষের সাথে একাত্ম হতে পারে না তা বিফলে যেতে বাধ্য। জোর করে সেই মতবাদ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিলেও মানুষ এক না একদিন তার ফাঁস কেটে বেরিয়ে আসবে। তারপর দেখা যাবে আন্দোলনটা কবে যেন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আর সেই আন্দোলনের ব্যর্থ নেতারা সেই সুখের সময়ের জাবর কাটতে কাটতে ভুলেই যায় যে তারা কবে জীবন্ত মমি হয়ে গেছে।
তবুও কী আশা নেই। অবশ্যই আছে। বারবার যত এই রকম রক্তপাতহীন আন্দোলন পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠবে, ততবার এই নতুন আন্দোলন তার পুরনো আন্দোলনের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে। আর তত ভুল শুধরে এক নতুন সমাজ তৈরি হবে। সেই শিক্ষিত সমাজ ধর্ম, রাজনীতি, মিডিয়ার বেড়া ভেঙ্গে এক নতুন পথের দিশা দেবে। যেখানে একা মানুষ দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেবে এক নতুন বিপ্লবের। সেই তৈরি করবে খবর, আর তার খবর লাইক করবে, শেয়ার করবে সম মনো ভাবাপন্ন মানুষ জন। পৃথিবীর বুকে এই রকম আন্দোলন আরও আসুক নেমে।


১৩/০২/২০১৩

Monday 4 February 2013

ইন্দ্রজাল কমিকস


আমরা যারা ছোটবেলা থেকে ইন্দ্রজাল কমিকস পড়েছি, তারা প্রতি সপ্তাহেই চেয়ে থাকতাম কবে আবার পরের সংখ্যাটা পাওয়া যাবে। প্রথমে পাওয়া যেত চারটি কমিকস
বেতাল, ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডন এবং বাহাদুর। পরে আরও কয়েকটা চরিত্র যোগ হয় গোয়েন্দা রিপ কার্বি, বাজ সয়্যার, গার্থ ও অন্যান্য। আমরা সাধারণত প্রথম চারটিকেই পছন্দ করতাম। আমরা যারা আনন্দবাজার পত্রিকা ও ইন্দ্রজাল কমিকস দুটোই পড়তাম, আমাদের কাছে ফ্যান্টম কখনোই বেতাল হয়ে ওঠে নি। সে সবসময়ই আমাদের কাছে অরণ্যদেব হয়েই রয়ে গেল। পড়ে বড় হয়ে শুনেছি অরণ্যদেব নামটা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-র দেওয়া। যারা শুধু ইন্দ্রজাল কমিকস পড়ত তারা বেতালই বলত। একই সময় দেশ পত্রিকাতেও অরণ্যদেব প্রকাশিত হত। পরে আরও জেনেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও অনেক সংখ্যার অরণ্যদেব বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ফলে অরণ্যদেবের সাথে পরিচয় অনেক প্রথম থেকেই। এই সময় কাগজে একবার যাত্রার বিজ্ঞাপনে অরণ্যদেব দেখে বাড়িতে বায়না করেছিলাম দেখতে যাব বলে। যাওয়া হয়ে ওঠেনি, বাবা বলল ওটা এই অরণ্যদেব নয়।
পরে বড় হয়ে পুরনো সংখ্যার ইন্দ্রজাল কমিকস নেড়ে চেড়ে দেখেছি। তখন জেনেছি যে ইন্দ্রজাল কমিকস টাইমস অফ ইন্ডিয়া প্রকাশনার আর এর সম্পাদক ছিলেন প্রীতিশ নন্দী। এখনও মনে পড়ে একটা পুরনো সংখ্যার কথা, তারাকিমোর শয়তান নামে একটা কমিকস তিন পর্বে বেরিয়েছিল। আমাদের বাড়িতে এই কমিকস বইটা বাড়িতে দিয়ে যেত পরেশ দাদু। তা প্রথম দুটো পর্ব বাংলায় দিয়েছিল, কিন্তু শেষটা দিল ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু ভাষার ব্যবধান ভুলে আগে গোগ্রাসে ছবি গিলেছি। ওই গল্পটায় ডায়না পামারকে অপহরণ করার গল্প ছিল। ডায়নাকে অজ্ঞান করে বুড়ি সাজিয়ে প্লেনে করে দেশের বাইরে তারাকিমোয় নিয়ে গিয়েছিল। এই সময় আরও নানান বেতালের কমিকস ছিল। ছবি আঁকার ভঙ্গী অনুযায়ী আমাদের কাছে তাদের নামও হয়ে গিয়েছিল নানান রকম। ভোতা বেতাল, ইত্যাদি। ভোতা বেতাল বলতে একুশতম অরণ্যদেবের গল্পগুলি আঁকা হত চল্লিশের দশকের সময় অনুযায়ী। এর মধ্য একটা গল্প মনে আছে বিশ্ব চাম্পিয়ন বক্সারকে হারিয়ে আবার তার চাম্পিয়নশিপ ফিরিয়ে দেওয়া। আবার একরকমের বেতাল গল্প ছিল যাতে বেতালকে আঁকা হত অন্যরকম করে। তার আঁকার পদ্ধতিও ছিল অন্যরকম। সেগুলি বেশিরভাগ বেতালের পুর্ব পুরুষদের নিয়ে লেখা। যেমন ভ্যকিউল দুর্গের কি যেন।
এরই মধ্যে একদিন বেরোল বেতালের বিয়ের খবর। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিল কতজন। তার মধ্যে ম্যানড্রেক, লোথার উপস্থিত ছিল। আমাদের ম্যানড্রেক ও লোথারের ছবি ভালো লাগেনি। পরে বুঝেছিলাম ম্যানড্রেকের ছবি যে আঁকত সে এই ছবিগুলো আঁকেনি। আমরা যারা ওই বয়সে বেতালের বিবাহ দেখেছিলাম, তাদের কাছে সারাক্ষণ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল এই বিয়ে। কিলাউইয়ের সোনালি তট, জেড পাথরে মধুচন্দ্রিমার ঘর, সলোমন-নেফারটিটির পিঠে উঠে ওয়াটার সার্ফিং, সব কি আর মনে আছে। হিজ-হার্জ, স্টেগি, নন্দনকানন, অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ আরও কত কী।এই সময় পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় ইন্দ্রজাল কমিকসের বিজ্ঞাপন বেরোত। বেতাল খুলি সিংহাসনে বাঁধা হয়ে পড়ে রয়েছে, সারা গা ডিনামাইট দিয়ে বাঁধা, সলতেতে আগুন জ্বলছে। এই গল্পটা কোনদিন পড়া না হয়ে ওঠা্র দুঃখ আজও রয়ে গেল। আজ এই বয়সেও একবিংশ অরণ্যদেব বুড়ো হল না। কিট-হেলওয়েজ বড় হল না, বুড়ো মজ এখনো গল্প বলে চলে। রেক্সের বিয়েও হল না। পুরনো রাজবাড়িতেও সে বনের দুঃখে কাঁদে। গুরান আজও পাহারা দেয়, তুফান-বাঘা এখনও দাপিয়ে চলে। পানশালায় আজও নীল কোট, চোখে কালো চশমা পড়া মি. ওয়াকার (বেতালের অন্য নাম)  এক গ্লাস দুধ চেয়ে বেড়ায়।
ম্যানড্রেক আগে শুধু আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়-তেই আসত। এখন নয় প্রতিদিনের কাগজেই পাওয়া যায়। কিন্তু ম্যানড্রেকের গল্পও আমাদের খুব টানত। তার মধ্যে -র কিছু গল্পতো অসাধারণ। রাজকুমার লোথার, হোজো আর নার্দ্রা। ম্যানড্রেকের বাবা থেরন, ভাই ডেরেক নানান চরিত্রে ম্যানড্রেক আমাদের মাতিয়ে রাখত। তখন মনে হত এই রকম গল্প নিয়ে পি. সি. সরকারকে নিয়ে একটা সিনেমা বা গল্পও তো হতে পারত। যখন গিলি গিলি গে  হল তখন ওই রকম মজা পাই নি।
যদিও আমার সবথেকে ভাল লাগত ফ্ল্যাশ গর্ডন। কিন্তু খুব কম পাওয়া যেত সে গল্প। সেরা ভিলেন চরিত্র ছিল মিঙফ্ল্যাশের সহকারী ড. জারকভ আর বান্ধবী ডেল। স্পেস স্যুট ছাড়া নানান গ্রহে অভিযান, মহাকাশ যান, নানান গ্রহের কল্প-রূপ, মিঙ-এর সাথে নানান অভিযান আমাদের শ্বাসরোধ করে রাখত। একই সময়ে দূরদর্শনে দেখতাম স্টার ট্রেক। ফলে মহাকাশ নিয়ে একটা অদ্ভুত ধারণা তৈরি হয়েছিলএই সময়ে পাশের বাড়ির বুস্টার অ্যান্টেনার সাথে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখতাম একটা সিরিয়াল, তাতে প্রধান ভিলেন ছিল মিঙ, আর নায়ক ছিল ফ্ল্যাশ গর্ডন, ফ্যান্টম আর ম্যানড্রেক। তাতে লোথার, জারকভ, ডেল, ডায়না, নার্দ্রা সবাই থাকত শুধু অভাব থাকত বাহাদুরের। তখন তো আর বুঝতাম না যে বাহাদুর একই কোম্পানির প্রোডাক্ট নয়। পরে বুঝেছি যে বাহাদুর একটি ভারতীয় কমিকস।
বাহাদুরের গল্পটা বেশ ভালো লাগত। গেরুয়া পাঞ্জাবি পড়া, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেরানো এক চরিত্র। গ্রামে ডাকাতদের সাথে লড়ে যাওয়া, সঙ্গে সুখিয়া, মুখিয়া। রুক্ষ্ম এক প্রকৃতির মধ্যে গল্প চলছে। ডাকাত সর্দারের ছেলেই বোধহয় বাহাদুর। কিন্তু ডাকাত তাড়ানোটাই তার প্রধান কর্তব্য। সে সময়ে রাজধানী ট্রেনে একটা গল্প মনে খুব দাগ রেখে গেছিল। কেননা তখন আমি জানতাম রাজধানী শুধু দিল্লি আর হাওড়ার মধ্যে চলে। আর গল্পটা ছিল যতদূর সম্ভব বোম্বে (তখনও মুম্বাই হয়নি) থেকে দিল্লির মধ্যে। মাঝে এক স্টেশনে খাবার তোলা হল, স্টেশনের নাম লেখা ছিল ভদোদরা (খুব সম্ভবতঃ এই বানান), কিছুতেই আর ম্যাপে এই স্টেশনটা খুঁজে পাই না, পরে বুঝেছি এটা বরোদা হবে।
এর পরেই আসে গোয়েন্দা রিপ কার্বি আর তার সঙ্গী ডেসমন্ড। শুধু গোয়েন্দা গল্পতেই আবদ্ধ থাকত না রিপ কার্বি। ভাল অ্যাডভেঞ্চার গল্পও থাকত। সোনা তৈরির গল্পটা অসাধারণ। ম্যানড্রেকের আগে প্রতিদিন আনন্দবাজারের পাতায় রিপ কার্বি ছাপা হত। তারপর রিপ কার্বি একটা কেসে হেরে যেতে রিপ কার্বি গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেয়।  তারপর থেকে আনন্দবাজারে রিপ কার্বি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কোন পাঠক রিপ কার্বিকে ফিরে আসার কথা বলে কোন চিঠি লেখেনি শার্লক হোমসের মত রিপ কার্বির আরও কিছু সম্মান পাওয়া উচিত ছিল বলে মনে হয়। অথচ পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় একবার রিপ কার্বির একটা সম্পূর্ণ চিত্র কাহিনী বেরিয়েছিল। অনেকটা সিন্ডারেলার গল্পের মত।
একই সময়ে বাজ সয়্যারের গল্পও বেরোত ইন্দ্রজাল কমিকস-এ। এটাও গোয়েন্দা গল্প, ছবি আঁকার ধাতটা ছিল একদম আলাদা। অনেকটা কমিক চরিত্র ধাঁচের। কিন্তু গল্প গুলো খুব ভালো লাগত। বাজ সয়্যারের কমিকসও একবার পুজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় সম্পূর্ণ বেরিয়েছিল।
গার্থ, কেরি ড্রেক সহ অন্যান্য কিছু কমিকস বেরিয়েছিল। সেগুলি এত প্রভাব ফেলে যায়নি। আমার মনের মধ্যে। ব্রুস লি-ও কি বেরিয়েছিল ইন্দ্রজালে ? ঠিক মনে করতে পারছি না।
ছোটবেলায় ইন্দ্রজাল কমিকস দেখে ভাবতাম এটা বোধহয় পি. সি. সরকারের ইন্দ্রজাল থেকে নাম নেওয়া। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ছবি। এই সময় কে. লালের মায়াজাল এল। আমি আর আমার ভাই দুজনেই লেগে গেলাম কমিকস তৈরির কাজে। নাম হল মায়াজাল কমিকস। দুজনে যেখানে যত নাম পেতাম তার তলায় কে আগে দাগ দেবে তার প্রতিযোগিতা চলত। যে আগে সেই নাম পাবে তাহলে সেই নামটা তার হয়ে যাবে, অন্য কেউ আর সে নামটা ব্যবহার করতে পারবে না অনেকটা পেটেন্টের মতএই করতে গিয়ে কত প্রাণীর সাথে পরিচয় হয়েছে, পড়া হয়ে গেছে কত বই। কোনান ডয়েলের লস্ট ওয়ার্ল্ড সম্পূর্ণ অনুবাদ কত ছোট বেলায় পড়া হয়ে গেছে শুধু ডাইনোসরের নাম জোগাড় করব বলে ওয়ার্ড বুক, ডিকসনারি কিছুই বাদ দিতাম না। শুধু ভাল ভাল ভিলেন খোঁজার জন্য। তারপর নানান আঁকা, কমিকসের মত করে তৈরি করা। সব কোথায় চলে গেল। ভাই এখনও আঁকা নিয়ে আছে। আর আমার, কিছু মায়া রয়ে গেল।


অভিমন্যু মজুমদার
২৮/০১/২০১৩