আমরা যারা ছোটবেলা থেকে ইন্দ্রজাল কমিকস পড়েছি, তারা প্রতি সপ্তাহেই চেয়ে থাকতাম কবে আবার পরের সংখ্যাটা পাওয়া যাবে। প্রথমে পাওয়া যেত চারটি কমিকস— বেতাল, ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডন এবং বাহাদুর। পরে আরও কয়েকটা চরিত্র যোগ হয়— গোয়েন্দা রিপ কার্বি, বাজ সয়্যার, গার্থ ও অন্যান্য। আমরা সাধারণত প্রথম চারটিকেই পছন্দ করতাম। আমরা যারা আনন্দবাজার পত্রিকা ও ইন্দ্রজাল কমিকস দুটোই পড়তাম, আমাদের কাছে ফ্যান্টম কখনোই বেতাল হয়ে ওঠে নি। সে সবসময়ই আমাদের কাছে অরণ্যদেব হয়েই রয়ে গেল। পড়ে বড় হয়ে শুনেছি অরণ্যদেব নামটা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-র দেওয়া। যারা শুধু ইন্দ্রজাল কমিকস পড়ত তারা বেতালই বলত। একই সময় দেশ পত্রিকাতেও অরণ্যদেব প্রকাশিত হত। পরে আরও জেনেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও অনেক সংখ্যার অরণ্যদেব বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ফলে অরণ্যদেবের সাথে পরিচয় অনেক প্রথম থেকেই। এই সময় কাগজে একবার যাত্রার বিজ্ঞাপনে অরণ্যদেব দেখে বাড়িতে বায়না করেছিলাম দেখতে যাব বলে। যাওয়া হয়ে ওঠেনি, বাবা বলল ওটা এই অরণ্যদেব নয়।
পরে বড় হয়ে পুরনো
সংখ্যার ইন্দ্রজাল কমিকস নেড়ে চেড়ে দেখেছি। তখন জেনেছি যে ইন্দ্রজাল কমিকস টাইমস
অফ ইন্ডিয়া প্রকাশনার আর এর সম্পাদক ছিলেন প্রীতিশ নন্দী। এখনও মনে পড়ে একটা পুরনো
সংখ্যার কথা, ‘তারাকিমোর শয়তান’ নামে একটা কমিকস তিন পর্বে বেরিয়েছিল। আমাদের বাড়িতে এই
কমিকস বইটা বাড়িতে দিয়ে যেত পরেশ দাদু। তা প্রথম দুটো পর্ব বাংলায় দিয়েছিল, কিন্তু
শেষটা দিল ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু ভাষার ব্যবধান ভুলে আগে গোগ্রাসে ছবি গিলেছি। ওই
গল্পটায় ডায়না পামারকে অপহরণ করার গল্প ছিল। ডায়নাকে অজ্ঞান করে বুড়ি সাজিয়ে
প্লেনে করে দেশের বাইরে তারাকিমোয় নিয়ে গিয়েছিল। এই সময় আরও নানান বেতালের কমিকস
ছিল। ছবি আঁকার ভঙ্গী অনুযায়ী আমাদের কাছে তাদের নামও হয়ে গিয়েছিল নানান রকম। ভোতা
বেতাল, ইত্যাদি। ভোতা বেতাল বলতে একুশতম অরণ্যদেবের গল্পগুলি আঁকা হত চল্লিশের
দশকের সময় অনুযায়ী। এর মধ্য একটা গল্প মনে আছে বিশ্ব চাম্পিয়ন বক্সারকে হারিয়ে
আবার তার চাম্পিয়নশিপ ফিরিয়ে দেওয়া। আবার একরকমের বেতাল গল্প ছিল যাতে বেতালকে
আঁকা হত অন্যরকম করে। তার আঁকার পদ্ধতিও ছিল অন্যরকম। সেগুলি বেশিরভাগ বেতালের
পুর্ব পুরুষদের নিয়ে লেখা। যেমন— ভ্যকিউল দুর্গের কি যেন।
এরই মধ্যে একদিন বেরোল
বেতালের বিয়ের খবর। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিল কতজন। তার মধ্যে ম্যানড্রেক, লোথার
উপস্থিত ছিল। আমাদের ম্যানড্রেক ও লোথারের ছবি ভালো লাগেনি। পরে বুঝেছিলাম
ম্যানড্রেকের ছবি যে আঁকত সে এই ছবিগুলো আঁকেনি। আমরা যারা ওই বয়সে বেতালের বিবাহ
দেখেছিলাম, তাদের কাছে সারাক্ষণ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল এই বিয়ে। কিলাউইয়ের সোনালি
তট, জেড পাথরে মধুচন্দ্রিমার ঘর, সলোমন-নেফারটিটির পিঠে উঠে ওয়াটার সার্ফিং, সব কি
আর মনে আছে। হিজ-হার্জ, স্টেগি, নন্দনকানন, অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ আরও কত কী।এই
সময় পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় ইন্দ্রজাল কমিকসের বিজ্ঞাপন বেরোত। বেতাল খুলি
সিংহাসনে বাঁধা হয়ে পড়ে রয়েছে, সারা গা ডিনামাইট দিয়ে বাঁধা, সলতেতে আগুন জ্বলছে। এই
গল্পটা কোনদিন পড়া না হয়ে ওঠা্র দুঃখ আজও রয়ে গেল। আজ এই বয়সেও একবিংশ অরণ্যদেব
বুড়ো হল না। কিট-হেলওয়েজ বড় হল না, বুড়ো মজ এখনো গল্প বলে চলে। রেক্সের বিয়েও হল
না। পুরনো রাজবাড়িতেও সে বনের দুঃখে কাঁদে। গুরান আজও পাহারা দেয়, তুফান-বাঘা এখনও
দাপিয়ে চলে। পানশালায় আজও নীল কোট, চোখে কালো চশমা পড়া মি. ওয়াকার (বেতালের অন্য
নাম) এক গ্লাস দুধ চেয়ে বেড়ায়।
ম্যানড্রেক আগে শুধু
আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়-তেই আসত। এখন নয় প্রতিদিনের কাগজেই পাওয়া যায়। কিন্তু
ম্যানড্রেকের গল্পও আমাদের খুব টানত। তার মধ্যে ‘৮’-র কিছু গল্পতো অসাধারণ। রাজকুমার লোথার, হোজো আর নার্দ্রা।
ম্যানড্রেকের বাবা থেরন, ভাই ডেরেক নানান চরিত্রে ম্যানড্রেক আমাদের মাতিয়ে রাখত। তখন
মনে হত এই রকম গল্প নিয়ে পি. সি. সরকারকে নিয়ে একটা সিনেমা বা গল্পও তো হতে পারত। যখন
গিলি গিলি গে হল তখন ওই রকম মজা
পাই নি।
যদিও আমার সবথেকে ভাল
লাগত ফ্ল্যাশ গর্ডন। কিন্তু খুব কম পাওয়া যেত সে গল্প। সেরা ভিলেন চরিত্র ছিল মিঙ। ফ্ল্যাশের সহকারী ড. জারকভ আর বান্ধবী ডেল। স্পেস স্যুট ছাড়া নানান গ্রহে
অভিযান, মহাকাশ যান, নানান গ্রহের কল্প-রূপ, মিঙ-এর সাথে নানান অভিযান আমাদের শ্বাসরোধ
করে রাখত। একই সময়ে দূরদর্শনে দেখতাম স্টার ট্রেক। ফলে মহাকাশ নিয়ে একটা অদ্ভুত
ধারণা তৈরি হয়েছিল। এই সময়ে পাশের বাড়ির বুস্টার অ্যান্টেনার সাথে বাংলাদেশ
টেলিভিশনে দেখতাম একটা সিরিয়াল, তাতে প্রধান ভিলেন ছিল মিঙ, আর নায়ক ছিল ফ্ল্যাশ গর্ডন,
ফ্যান্টম আর ম্যানড্রেক। তাতে লোথার, জারকভ, ডেল, ডায়না, নার্দ্রা সবাই থাকত শুধু
অভাব থাকত বাহাদুরের। তখন তো আর বুঝতাম না যে বাহাদুর একই কোম্পানির প্রোডাক্ট নয়।
পরে বুঝেছি যে বাহাদুর একটি ভারতীয় কমিকস।
বাহাদুরের গল্পটা বেশ
ভালো লাগত। গেরুয়া পাঞ্জাবি পড়া, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেরানো এক চরিত্র। গ্রামে
ডাকাতদের সাথে লড়ে যাওয়া, সঙ্গে সুখিয়া, মুখিয়া। রুক্ষ্ম এক প্রকৃতির মধ্যে গল্প
চলছে। ডাকাত সর্দারের ছেলেই বোধহয় বাহাদুর। কিন্তু ডাকাত তাড়ানোটাই তার প্রধান
কর্তব্য। সে সময়ে রাজধানী ট্রেনে একটা গল্প মনে খুব দাগ রেখে গেছিল। কেননা তখন আমি
জানতাম রাজধানী শুধু দিল্লি আর হাওড়ার মধ্যে চলে। আর গল্পটা ছিল যতদূর সম্ভব
বোম্বে (তখনও মুম্বাই হয়নি) থেকে দিল্লির মধ্যে। মাঝে এক স্টেশনে খাবার তোলা হল,
স্টেশনের নাম লেখা ছিল ভদোদরা (খুব সম্ভবতঃ এই বানান), কিছুতেই আর ম্যাপে এই
স্টেশনটা খুঁজে পাই না, পরে বুঝেছি এটা বরোদা হবে।
এর পরেই আসে গোয়েন্দা
রিপ কার্বি আর তার সঙ্গী ডেসমন্ড। শুধু গোয়েন্দা গল্পতেই আবদ্ধ থাকত না রিপ কার্বি।
ভাল অ্যাডভেঞ্চার গল্পও থাকত। সোনা তৈরির গল্পটা অসাধারণ। ম্যানড্রেকের আগে
প্রতিদিন আনন্দবাজারের পাতায় রিপ কার্বি ছাপা হত। তারপর রিপ কার্বি একটা কেসে হেরে
যেতে রিপ কার্বি গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেয়। তারপর
থেকে আনন্দবাজারে রিপ কার্বি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কোন পাঠক রিপ কার্বিকে ফিরে
আসার কথা বলে কোন চিঠি লেখেনি শার্লক হোমসের মত। রিপ কার্বির আরও কিছু
সম্মান পাওয়া উচিত ছিল বলে মনে হয়। অথচ পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় একবার রিপ কার্বির
একটা সম্পূর্ণ চিত্র কাহিনী বেরিয়েছিল। অনেকটা সিন্ডারেলার গল্পের মত।
একই সময়ে বাজ
সয়্যারের গল্পও বেরোত ইন্দ্রজাল কমিকস-এ। এটাও গোয়েন্দা গল্প, ছবি আঁকার ধাতটা ছিল
একদম আলাদা। অনেকটা কমিক চরিত্র ধাঁচের। কিন্তু গল্প গুলো খুব ভালো লাগত। বাজ
সয়্যারের কমিকসও একবার পুজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় সম্পূর্ণ বেরিয়েছিল।
গার্থ, কেরি ড্রেক সহ
অন্যান্য কিছু কমিকস বেরিয়েছিল। সেগুলি এত প্রভাব ফেলে যায়নি। আমার মনের মধ্যে। ব্রুস
লি-ও কি বেরিয়েছিল ইন্দ্রজালে ? ঠিক মনে করতে পারছি না।
ছোটবেলায় ইন্দ্রজাল
কমিকস দেখে ভাবতাম এটা বোধহয় পি. সি. সরকারের ইন্দ্রজাল থেকে নাম নেওয়া। আলাদিনের
আশ্চর্য প্রদীপের ছবি। এই সময় কে. লালের মায়াজাল এল। আমি আর আমার ভাই দুজনেই লেগে
গেলাম কমিকস তৈরির কাজে। নাম হল মায়াজাল কমিকস। দুজনে যেখানে যত নাম পেতাম তার
তলায় কে আগে দাগ দেবে তার প্রতিযোগিতা চলত। যে আগে সেই নাম পাবে তাহলে সেই নামটা
তার হয়ে যাবে, অন্য কেউ আর সে নামটা ব্যবহার করতে পারবে না অনেকটা পেটেন্টের মত। এই করতে গিয়ে কত প্রাণীর সাথে পরিচয় হয়েছে, পড়া হয়ে গেছে কত বই। কোনান ডয়েলের লস্ট
ওয়ার্ল্ড সম্পূর্ণ অনুবাদ কত ছোট বেলায় পড়া হয়ে গেছে শুধু ডাইনোসরের নাম জোগাড়
করব বলে। ওয়ার্ড বুক, ডিকসনারি কিছুই বাদ দিতাম না। শুধু ভাল ভাল
ভিলেন খোঁজার জন্য। তারপর নানান আঁকা, কমিকসের মত করে তৈরি করা। সব কোথায় চলে গেল।
ভাই এখনও আঁকা নিয়ে আছে। আর আমার, কিছু মায়া রয়ে গেল।
অভিমন্যু মজুমদার
২৮/০১/২০১৩
Darun lekha! Apanar ei post age kokhono dekhini...Ekjon Indrajal Comics-er addict hisebe bolte pari,ja likhechen ogulo thik amaro monek katha! Chotobelay ABP temon pora hotona,Bartamna rakha hoto(jate chilo TARZAN),kintu majhe sajhe Aranyadev/Goyenda Rip portam,jodio Rip tokhon oto bhalo lagtona...r Robibasoriyo-te chilo Mandrake...ekhn r oi strip gulo paowa jayna,ABP-o right kine re-print korlona! :(
ReplyDeleteAnyway,4 yr age amio ABP-r 3 Ijc choritro niye likhechilam amar blog-e(Feb 2011 archive) : http://dara-indrajal.blogspot.in/2011_02_01_archive.html
Poriseshe boli,RIP KIRBY bondho hoye jay 1999-e(ABP-te early 2000 karon ora kyek mass pichiye thakto) karon artist-cum-writer John PRENTICE mara jan ek car accident-e...tarpor KFS r continue koreni...!!
৭৮-৭৯ সালে আমরাও টারজান পড়তাম, তবে আনন্দমেলায়। টারজানের ছেলে কোরক, লীলা, সেই জলযান। অবাক করে কিছুদিন আগে ওই বছরের আনন্দমেলা গুলো বাঁধাই পেয়ে গেলাম।
DeleteApnar kache jodi purono ABP-r oi 3 te strip-er cutting thake ektu FB te post korben...
ReplyDeleteR thiki bolechen,Kirby ekbari Anandamela pb te esechilo,Harano meye in 1388 pb,jar ami Eng ver-ta post korechi kyek mass age : http://dara-indrajal.blogspot.in/2014/12/comic-117-rip-kirby-adventure-hunt-for.html
Abhimanyu - a very nice write up .
ReplyDelete"বেতাল খুলি সিংহাসনে বাঁধা হয়ে পড়ে রয়েছে, সারা গা ডিনামাইট দিয়ে বাঁধা, সলতেতে আগুন জ্বলছে। এই গল্পটা কোনদিন পড়া না হয়ে ওঠা্র দুঃখ আজও রয়ে গেল....." এই গল্পটা এখান থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারো : http://indraindrajal.blogspot.com/2014/04/post-244-bengali-indrajal-comics-no228.html - যদি English version লাগে তো জানিও - আর বেশ কিছু Rip Kirby (English) এখান থেকে ডাউনলোড করতে পারো : http://galpoghar.blogspot.com/ keep on good writing...
The Return of Indrajal Comics
ReplyDeleteBhai tumi guliye phelecho..vick guthry roverser choritro..indrajal er noy..ota Garth ba dara ba kery drake hobe! Erokom bhul koro na..
আমার ফেসবুক পেজ -এ একটা ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দ্য রিটার্ন অফ ইন্দ্রজাল কমিকস এর অ্যাডমিন কে ধন্যবাদ ওটা গার্থ হবে, আমি বদলে দিয়েছি। ধন্যবাদ।